আগের পর্বে বলা হয়েছে মিরজাফর ও তার পরিবার সামান্য চাকরির জন্য দিল্লী থেকে মুর্শিদাবাদ আসেন। নবাব আলীবর্দি খান বলা চলে রাস্তা থেকে ধরে এনে মিরজাফরকে প্রথমে বখসি এবং পরে প্রধান সেনাপতি পদে বসান। লোভী মিরজাফরের মধ্যে পরবর্তীতে বাংলার সিংহাসনে বসার খায়েস জাগে। এ জন্য মিরজাফর অন্নদাতা আলীবর্দির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। নবাবের আরেক বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি আতাউল্লাহ খানের ষড়যন্ত্র শুরু করেন। গোয়েন্দার মাধ্যমে আলীবর্দি অবহিত হন। টের পেয়ে শাস্তির ভয়ে আতাউল্লাহ খান গোপনে বাংলা ত্যাগ করেন। মিরজাফরকে ১৭৫১/ ৫২ সালে প্রধান সেনাপতি থেকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু আলীবর্দির জামাতা অর্থাৎ ঘসেটি বেগমের স্বামী নওয়াজেশ আহমেদ এতে বাধ সাধেন। তিনি ছিলেন মিরজাফরের বন্ধু। তিনি প্রভাব খাটিয়ে মিরজাফরকে পুনরায় প্রধান সেনাপতি পদে বহাল রাখেন।
মিরজাফর অবশ্য নওয়াজিশ খানের এ উপকারের প্রতিদান দিয়েছিলেন পলাশী যুদ্ধের পর। ততদিনে নওয়াজিশ মারা গেছেন। আর ঘসেটি বেগমকে বন্দী করে ঢাকার কেরানীগঞ্জের কারাগারে রাখেন মিরজাফর। পরে বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে তার প্রাণ সংহার করা হয়। যাই হোক, আলীবর্দি পরলোকগমনের পূর্বে নাতি সিরাজকে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তরসূরি নির্বাচন করেন। রাজকীয় ঘোষনার দিন দরবার হলে সেনাপতি মিরজাফরকে পবিত্র কোরআন হাতে শপথ গ্রহন করানো হয়- যাতে তিনি সিরাজকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেবা দেন। কিন্তু মিরজাফর কথা রাখেননি। কথা রাখার স্বভাব তার কোনো দিনই ছিলনা। পলাশী যুদ্ধে পুতুলের ভূমিকায় নামলে নবাব সিরাজ সেনাপতি মিরজাফরকে শিবিরে ডেকে পাঠান। নিজের রাজমুকুট মিরজাফরের পায়ে রেখে দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় যুদ্ধে নামার আকুল আহবান জানান। মিরজাফর ‘আগামীকাল যুদ্ধ হবে’ আশ্বস্ত করে শিবির ত্যাগ করেন। এর পর পলাশী যুদ্ধে কি হয়েছিল পাঠক মাত্রই তা জানেন।
স্মরন করিয়ে দেয়া দরকার যে, সিরাজের প্রতি মিরজাফরের খেদ ছিল বহুমাত্রিক। সিরাজ মসনদে আরোহন করলে মিরজাফর প্রথমে নবাবের খালাতো ভাই ও পাটনার শাসনকর্তা শওকত জঙ্গকে মুর্শিদাবাদের নবাব হওয়ার জন্য উসকানি দিতে থাকেন। সিরাজ তা বুঝতে পেরে শওকত জঙ্গকে যুদ্ধে পরাজিত ও হত্যা করেন। এরপর ঘসেটি বেগমকে সিরাজের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তোলা হয়। ক্ষমতার তিন মাসের মাথায় সিরাজ বাধ্য হয়ে মিরজাফরকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নানা মাত্রার ষড়যন্ত্র এবং নানী শরীফুনেচ্ছার অনুরোধে মিরজাফরকে আবার স্বপদে ফিরিয়ে আনা হয়। পলাশী যুদ্ধের পর মিরজাফর নবাব হলে মুর্শিদাবাদ রাজভান্ডার লুন্ঠিত হয়। এর সিংহ ভাগ পায় ইংরেজ। দুশো নৌকায় ভরে কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ, হীরাজহরত মুর্শিদাবাদ থেকে কোলকাতায় নিয়ে যায়। বিনিময়ে মিরজাফর পান একটি অর্গান ক্লক। কথিত রয়েছে, ক্লাইভ রৌপ্য নির্মিত অগার্ণ ক্লকটি হস্তান্তরের সময় মিরজাফর তার হাতে চুমো খান। বলেন, “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয় হোক। এ উপহার স্বর্ণরৌপ্যের চেয়ে অনেক দামি। এটি ভালোবাসার প্রতীক। আপনারা পরীক্ষিত বন্ধু। আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’’
মিরজাফরের প্রভূভক্তি ইংরেজদের খুব বেশি দিন আকৃষ্ট করতে পারেনি। অযোগ্যতার দরুন বেতন বকেয়া পড়লে শীঘ্রই মুর্শিদাবাদে সেনা বিদ্রোহ দেখা দেয়। আলোচনার নামে ইংরেজরা মিরজাফরকে কোলকাতায় ডেকে নিয়ে নবাবী থেকে বরখাস্ত করে। জামাতা মির কাশিমকে বাংলার নবাব করা হয়। এভাবে ইংরেজ কুঠিরে নবাব বানানো আর নামানো শুরু হয়। মির কাশিম ছিলেন স্বাধীনচেতা। তাই ইংরেজদের সাথে বিবাদ তৈরি হয়। যার পরিণতি ১৭৬৪ সালের বক্সার যুদ্ধ ও মির কাশিমের পরাজয়। এ সময়ও মিরজাফর জামাতা মির কাশিমের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। আর পুরস্কার স্বরুপ ইংরেজরা তাকে দ্বিতীয় বার নবাব বানান।
মিরজাফর দ্বিতীয় দফা ক্ষমতারোহন করে খুব একটা রাজদরবারে বসতেন না। কারণ নবাবের হাতে ক্ষমতা বা কাজ কোনটিই ছিলনা। প্রথম দিকে জাফরাগঞ্জের প্রাসাদে এবং পরে নূরবাগ কেল্লার চেহেলসাতু প্রাসাদে অবস্থান করতেন। এ সময় সর্বক্ষন বাঈজী ও বারঙ্গনা পরিবেষ্টিত থাকতেন। মদ ছাড়াও ভাং ও হাশিশ সেবনে অভ্যস্থ ছিলেন তিনি। এক সাথে দুই বাঈজী মুন্নী ও বাব্বী বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। মুন্নী বেগমের গর্ভজাত নাজমুদ্দৌলা মিরজাফরের মৃত্যূর পর নবাব হন। এভাবে সেই বিশ্বাসহন্তা ও ষড়যন্ত্রের যুগে বাদী থেকে বেগম এবং বাঈজী পুত্রদের খান্দানী উপাধি দিয়ে নবাব বানানোর হাস্যকর ভূমিকায় অবতীর্ন হন ইংরেজ কোম্পানি।
তবে মিরজাফরের শেষ জীবন সুখের ছিলনা। জীবনের সব অপকর্মের ফলাফল তিনি হাতেনাতে পেয়েছিলেন বলে সমসাময়িক গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। মিরজাফর কুষ্ঠ ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে রাজকীয় হাকিম অনিরাময়যোগ্য ঘোষনা দেন। দিল্লীর মুঘল দরবার থেকে বিখ্যাত হাকিম মির্জা সবুর হাক্কানিকে নিয়ে আসা হয়। তিনি ও ব্যর্থ হন। পরে নবাবী মহলের খাস বরদার অসীম কৃষ্ণ রায়ের পরামর্শে মুর্শিদাবাদের কিরীটেশ্বর মন্দিরের পুরোহিতের আশ্রয় নেন। ওই পুরোহিত মন্দিরে রক্ষিত বিগ্রহের পা ধোঁয়া জল সকাল-বিকাল সেবনের পরামর্শ দেন। জল সেবন চলে বেশ ক’মাস। কিন্তু রোগ উপশমের কোনো লক্ষণ ছিলনা। চলাচল রহিত হওয়া পঁচাত্তর বছর বয়সী মিরজাফর এক পর্যায়ে বাকশূণ্য হয়ে পড়েন। মৃত্যূর তিন দিন আগে ধনসম্পদ বাটোয়ারা নিয়ে দুই স্ত্রী মুন্নী ও বাব্বী বেগম ঝগড়া বাঁধিয়ে চেহেলগাজী প্রাসাদ ত্যাগ করেন। আর মিরজাফর নিঃসঙ্গ অবস্থায় পাড়ি জমান। জীবনের অনেক কুকীর্তির দায় নিয়ে ইতিহাসের পাতায় তার স্থান। আর পাতা উল্টে পাঠকরা মিরজাফরনামা ও মিরজাফর চরিত পাঠ করে ঘৃণায় মুখ লুকান।
ছবি : মুর্শিদাবাদের জাফরগঞ্জে মিরজাফরের রাজপ্রাসাদ। কারো কারো মতে, এখানেই সিরাজকে হত্যা করা হয়। তাই এটিকে বিশ্বাসঘাতকের দেউড়ি বলা হয়।
প্রতিবেদক : এডিটর, গোপালপুর বার্তা ২৪. কম, দৈনিক ইত্তেফাকের গোপালপুর সংবাদদাতা এবং মধুপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।